November 28, 2018
দেবী হুমায়ূন আহমেদ মাঝরাতের দিকে রানুর ঘুম ভেঙ্গে গেল। তার মনে হলো ছাদে কে যেন হাঁটছে। সাধারণ মানুষের হাঁটা নয়, পা টেনে টেনে হাঁটা। সে ভয়ার...
Debi by Humayun Ahmed
Debi by Humayun Ahmed
Debi by Humayun Ahmed
8
10
99
দেবী
হুমায়ূন আহমেদ
মাঝরাতের দিকে রানুর ঘুম ভেঙ্গে গেল।
তার মনে হলো ছাদে কে যেন হাঁটছে। সাধারণ মানুষের হাঁটা নয়, পা টেনে টেনে হাঁটা। সে ভয়ার্ত গলায় ডাকল, ‘এই, এই।’ আনিসের ঘুম ভাঙল না। বাইরে টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। অল্প-অল্প বাতাস। বাতাসে জামগাছের পাতায় অদ্ভুদ এক রকমের শব্দ উঠছে। রানু আবার ডাকল, ‘এই, একটু ওঠ না। এই।’
‘কী হয়েছে?’
‘কে যেন ছাদে হাঁটছে।’
‘কী যে বল! কে আবার ছাদে হাঁটবে? ঘুমাও তো।’
‘প্লীজ, একটু উঠে বস। আমার বড় ভয় লাগছে।’
আনিস উঠে বসল। প্রবল বর্ষণ শুরু হলো এই সময়। ঝমঝম করে বৃষ্টি। জানালার পর্দা বাতাসে পতপত করে উড়তে লাগল। রানু হঠাৎ দেখল, জানালার শিক ধরে খালিগায়ে একটি রোগামতো মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। মানুষটির দুটি হাতই অসম্ভব লম্বা। রানু ফিসফিস করে বলল, ‘ওখানে কে?’
‘কোথায় কে?’
‘ঐ যে জানালায়।’
‘আহ কী যে ঝামেলা কর! নারকেল গাছের ছায়া পড়েছে।’
‘একটু বাতিটা জ্বালাও না।’
‘রানু তুমি ঘুমোও তো।’
আনিস শোবার উপক্রম করতেই ছাদে বেশ কয়েক বার থপাথপ শব্দ হলো। যেন কেউ-এক জন ছাদে লাফাচ্ছে।
রানু চমকে উঠে বলল, ‘কিসের শব্দ?’
‘বানর। এ জায়গায় বানর আছে। কালই তো দেখলে ছাদে লাফালাফি করছিল।
‘আমার বড় ভয় করছে। একটু উঠে গিয়ে বাতিটা জ্বালাও না। পায়ে পড়ি তোমার।’
আনিস বাতি জ্বালাল। ঘড়িতে বাজে দেড়টা। ছাদে আর কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছে না। তবু রানুর ভয় কমল না।
সে কেঁপে-কেঁপে উঠতে লাগল।
আনিস বিরক্ত স্বরে বলল, ‘এরকম করছ কেন?’
‘কেন জানি অন্য রকম লাগছে আমার। একটা খুব খারাপ স্বপ্ন দেখেছি।’
‘কী স্বপ্ন?’
‘দেখলাম আমি যেন….
কথার মাঝখানে হঠাৎ রানু থেমে গেল। কে যেন হাসছে। ভারি গলায় হাসছে। রানু কাঁপা স্বরে বলল, ‘হাসির শব্দ শুনতে পাচ্ছ? কে যেন হাসছে।’
‘কে আবার হাসবে। বানরের শব্দ। কিংবা কেউ হয়তো জেগে উঠেছে দোতলায়।’
আনিস লক্ষ্য করল, রানু খুব ঘামছে। চোখ-মুখ রক্তশূণ্য। বালিশের নিচ থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করল। দেশলাই জ্বালাতে-জ্বালাতে বলল, ‘কী স্বপ্ন দেখেছিলে?’
‘দিনের বেলা বলব।’
‘কী যে সব কুসংস্কার তোমাদের! এখনো ভয় লাগছে?’
‘হ্যাঁ।
‘ভয়টা কিসের? চোর-ডাকাতের, না ভূতের?’
‘বুঝতে পারছি না।’
‘ঠিক আছে বাতি জ্বালানোই থাক। বাতি জ্বালিয়েই ঘুমাব আজকে। এখন বল দেখি কী স্বপ্ন দেখলে?’
‘দিনের বেলা বলব।’
‘আহ্ বল না! বললেই ভয় কেটে যাবে।’
রানু আনিসের বাঁ হাত শক্ত করে চেপে ধরল। থেমে-থেমে বলল, ‘দেখলাম, একটা ঘরে আমি শুয়ে আছি। একটা বেঁটে লোক এসে ঢুকল। তারপর দেখলাম, সে আমার শাড়ি টেনে খুলে ফেলার চেষ্টা করছে।’
আনিস শব্দ করে হাসল।
রানু বলল, ‘হাসছ কেন?’
‘হাসব না? এটা কি একটা ভয় পাওয়ার স্বপ্ন?’
‘তুমি তো সবটা শোনো নি।’
‘সবটা শুনতে হবে না। পরে কী হবে তা আমার জানা। তুমি যা দেখেছ তা হচ্ছে একটা সেক্সুয়াল ফ্যান্টাসি। যুবক-যুবতীরা এ রকম স্বপ্ন প্রায়ই দেখে।’
‘আমি দেখি না।’
‘তুমিও দেখ। মনে থাকে না তোমার।’
‘আমি স্বপ্ন খুব কম দেখি। যা দেখি তা সব সময় সত্যি হয়। তোমাকে তো বলেছি অনেক বার।’
আনিস চুপ করে রইল। রানু এই কথাটি প্রায়ই বলে। বিয়ের রাতে প্রথম বার বলেছিল। আনিস সেবারও হেসেছে। রানু অবাক হয়ে বলেছে, ‘আপনি আমার কথা বিশ্বাস করলেন না, না?’
‘নাহ।’
‘আমি আমি আপনার গা ছুঁয়ে বলছি, বিশ্বাস করুন আমার কথা।’
রানু এমনভাবে বলল, যেন আনিসের বিশ্বাসের উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। আনিস শেষ পর্যন্ত হাসি মুখে বলল, ‘ঠিক আছে বিশ্বাস করলাম, এখন দয়া করে আপনি-আপনি বলবে না।’ রানু ফিসফিস করে বলল, ‘আপনার সঙ্গে যে আমার বিয়ে হবে, সেটাও আমি জানতাম।’
‘এটাও স্বপ্নে দেখেছিলে?’
‘হুঁ। দেখলাম, একটি লোক খালিগায়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার পেটের কাছে একটা মস্ত কাটা দাগ। লোকটিকে দেখেই আমার মনে হলো, এর সঙ্গে আমার বিয়ে হবে। আমি তাকে বললাম, কেটেছে কীভাবে? আপনি বললেন, ‘সাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছিলাম।’
আনিস সে রাতে দীর্ঘক্ষণ কোনো কথা বলতে পারে নি। তার পেটে কেটা কাটা দাগ সত্যি-সত্যি আছে, এই মেয়েটির সেটি জানার কথা নয়। তবে সাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে কাটে নি। জামগাছ থেকে পিছলে পড়ে কেটেছে। ব্যাপারটা কাকতালীয়, বলাই বাহুল্য। মাঝে-মাঝে এমন দুই-একটা জিনিস খুব মিলে যায়। তবুও কোথায় যেন একটা ক্ষীণ অস্বস্তি থাকে।
বাইরে বৃষ্টি খুব বাড়ছে। ঝড়টর হবে বোধহয়। শোঁ-শোঁ আওয়াজ হচ্ছে জানালায়। একটি কাঁচ ভাঙ্গা। প্রচুর পানি আসছে ভাঙ্গা জানালা দিয়ে, শীত-শীত করছে।
‘রানু চল ঘুমিয়ে পড়ি।’
‘সিগারেট শেষ হয়েছে?’
‘হ্যাঁ।’
বিছানায় ওঠামাত্র প্রবল শব্দে বিদ্যুৎ চমকাল। বাতি চলে গেল সঙ্গে-সঙ্গে। শুধু এ অঞ্চল নয়, সমস্ত ঢাকাই বোধ করি অন্ধকার হয়ে গেল। আনিস বলল, ‘ভয় লাগছে রানু?’
‘হ্যাঁ।
‘আচছা একটা হাসির গল্পটল্প কর। এতে ভয় কমে যায়। বল একটা গল্প।’
‘তুমি বল।’
আনিস দীর্ঘ সময় নিয়ে এক জন পাদ্রী ও তিনটি ইহুদি ও তিনটি মেয়ের গল্প বলল। গল্পের এক পর্যায়ে শ্রোতাকে জিজ্ঞেস করতে হয়–পাদ্রী তখন কী বলল?
এর উত্তরটি হচ্ছে পাঞ্চ লাইন, কিন্তু কিচ্ছু জিজ্ঞেস করল না রানু। সে কি শুনছে না? আনিস ডাকল, ‘এই রানু, এই!’ রানু কথা বলল না। বাতাসের ঝাপটায় সশব্দে জানালার একটি পাল্লা খুলে গেল। আনিস বন্ধ করার জন্য উঠে দাঁড়াতেই রানু তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁপা গলায় বলল, ‘তুমি যেও না। খবরদার, যেও না!’
‘কী আশ্চর্য, কেন?’
‘একটা-কিছু জানালার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে।’
‘কী যে বল!’
‘প্লীজ, প্লীজ।’
রানু কেদে ফেলল। ফোঁপাতে-ফোঁপাতে বলল, ‘তুমি গন্ধ পাচ্ছ না?’
‘কীসের গন্ধ?’
‘কর্পূরের গন্ধের মতো গন্ধ।’
এটা কি মনের ভুল? সু্ক্ষ্ম একটা গন্ধ যেন পাওয়া যাচ্ছে ঘরে। ঝনঝন করে আরেকটা কাঁচ ভাঙল। রানু বলল, ‘ঐ জিনিসটা হাসছে। শুনতে পাচ্ছ না?’ বৃষ্টির শব্দ ছাড়া আনিস কিছু শুনতে পেল না।
‘তুমি বস তো। আমি হারিকেন জ্বালাচ্ছি।’
‘না তুমি আমাকে ধরে বসে থাক।’
আনিস অস্বস্তির সঙ্গে বলল, ‘তুমি ঐ জানালাটার দিকে আর তাকিও না তো!’ আনিস লক্ষ্য করল, রানু থরথর করে কাঁপছে, ওর গায়ের উত্তাপও বাড়ছে। রানুকে সাহস দেবার জন্যে সে বলল, ‘কোনো দোয়া-টোয়া পড়লে লাভ হবে? আয়াতুল কুর্সি জানি আমি। আয়াতুল কুর্সি পড়ব?’
রানু জবাব দিল না। তার চোখ বড়-বড় হয়ে উঠছে। মুখ দিয়ে ফেনা ভাঙছে নাকি? শ্বাস ফেলছে টেনে-টেনে।
‘এই রানু, এই।’
কোনোই সাড়া নেই। আনিস হ্যারিকেন জ্বালাল। রান্নাঘর থেকে খুটখুট শব্দ আসছে। ইঁদুর, এতে সন্দেহ নেই। তবু কেন জানি ভালো লাগছে না। আনিস বারান্দায় এসে ডাকল, ‘রহমান সাহেব, ও রহমান সাহেব।’ রহমান সাহেব বোধহয় জেগেই ছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে বেরুলেন।
‘কী ব্যাপার?’
‘আমার স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েছে।’
‘কী হয়েছে?’
‘বুঝতে পারছি না।’
‘হাসপাতালে নিতে হবে নাকি?’
‘বুঝতে পারছি না।’
‘আপনি যান, আমি আসছি। এক্ষুণি আসছি।’
আনিস ঘরে ফিরে গেল। মনের ভুল, নিঃসন্দেহে মনের ভুল। আনিসের মনে হলো সে ঘরের ভেতর গিয়ে দাঁড়ানো মাত্র কেউ-এক জন যেন দরজার আড়ালে সরে পড়ল। রোগা, লম্বা একটি মানুষ। আনিস ডাকল, ‘রানু।’ রানু তৎক্ষণাৎ সাড়া দিল, ‘কি?’
ইলেকট্রিসিটি চলে এল তখনই। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই রহমান সাহেব এসে উপস্থিত হলেন। উদ্বিগ্ন স্বরে বললেন, ‘এখন কেমন অবস্থা?’ রানু অবাক হয়ে বলল, ‘কিসের অবস্থা? কী হয়েছে?’
রহমান সাহেব অবাক হয়ে তাকালেন। আনিস বলল, ‘তোমার শরীর খারাপ করেছিল, তাই ওঁকে ডেকেছিলাম। এখন কেমন লাগছে?’
‘ভালো।’
রানু উঠে বসল। রহমান সাহেবের দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল, ‘এখন আমি ভালো।’
রহমান সাহেব তবু মিনিট দশেক বসলেন। আনিস বলল, ‘আপনি কি ছাদে দাপাদাপি শুনেছেন?’
‘সে তো রোজই শুনি। বাঁদরের উৎপাত।’
‘আমিও তাই ভাবছিলাম।’
‘খুব জ্বালাতন করে। দিনে-দুপুরে ঘর থেকে খাবারদাবার নিয়ে যায়।’
‘তাই নাকি?’
‘জ্বি। নতুন এসেছেন তো! কয়েক দিন যাক টের পাবেন। বাড়িঅলাকে বলেছিলাম গ্রিল দিতে। তা দেবে না। আপনার সঙ্গে দেখা হলে আপনিও বলবেন। সবাই মিলে চেপে ধরতে হবে।’
‘জ্বি, আমি বলব। আপনি কি চা খাবেন না কি এক কাপ?’
‘আরে না না! এই রাত আড়াইটার সময় চা খাব নাকি, কী যে বলেন! উঠি ভাই। কোনো অসুবিধা হলে ডাকবেন।’
ভদ্রলোক উঠে পড়লেন। রানু চাপা স্বরে বলল, ‘এই রাত-দুপুরে ভদ্রলোককে ডেকে আনলে কেন? কী মনে করলেন উনি!’
‘তুমি যা শুরু করেছিলে! ভয় পেয়েই ভদ্র লোককে ডাকলাম।’
‘কী করেছিলাম আমি?’
‘অনেক কান্ড করেছ। এখন তুমি কেমন, সেটা বল।’
‘ভালো।’
‘কী রকম ভালো?
‘বেশ ভালো।’
‘ভয় লাগছে না আর?’
‘নাহ।’
রানু বিছানা থেকে নেমে পড়ল। সে বেশ সহজ ও স্বাভাবিক। ভয়ের কোনো চিহ্নও নেই চোখে-মুখে। শাড়ি কোমরে জড়িয়ে ঘরের পানি সরাবার ব্যবসা করছে।
‘সকালে যা করার করবে। এখন এসব রাখ তো।’
‘ইস, কী অবস্থা হয়েছে দেখ না!’
‘হোক, এস তো এদিকে।’
রানু হাসি-হাসি মুখে এগিয়ে এল।
‘এখন আর তোমার ভয় লাগছে না?’
‘না।’
‘জানালার ওপাশে কে যেন দাঁড়িয়েছিল বলেছিলে?’
‘এখন কেউ নেই। আর থাকলেও কিছু যায় আসে না।’
আনিস দ্বিতীয় সিগারেটটা ধরাল। হালকা গলায় বলল, ‘এক কাপ চা করতে পারবে?’
‘চা, এত রাতে!’
‘এখন আর ঘুম আসবে না, কর দেখি এক কাপ।’
রানু চা বানাতে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই পানি ফোটার শব্দ হলো। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে ঝমঝম করে। রানু একা-একা রান্নাঘরে। কে বলবে এই মেয়েটিই অল্প কিছুক্ষণ আগে ভয়ে অস্থির হয়ে গিয়েছিল! ছাদে আবার ঝুপঝুপ শব্দ হচ্ছে। এই বৃষ্টির মধ্যে বানর এসেছে নাকি? আনিস উঠে গিয়ে রান্না ঘরে উঁকি দিল। হালকা গলায় বলল, ছাদে বড় ধুপধাপ শব্দ হচ্ছে?’ রানু জবাব দিল না।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 Comments: